লিভারঃ
লিভার হল দেহের সবচেয়ে বড় গ্রন্থিময় অঙ্গ। ইহা অনেক জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহে থেকে বিষাক্ত ও ক্ষতিকর উপাদান দূর করে দেহকে বিশুদ্ধ রাখে।
একজন বয়স্ক মানুষের লিভারের ওজন সাধারণত ১.৪৪-১.৬৬ কেজি (৩.২-৩.৭ পাউন্ড)। এটি পেটের উপরের দিকের ডান পাশে, ডায়াফ্রাম এর নিচে এবং পাকস্থলির ডান পাশে অবস্থিত। লিভারে চারটি লোব রয়েছে। এটি প্রতি মিনিটে ১.৫ কোয়ার্টার রক্ত হেপাটিক আর্টারী ও পোর্টাল ভেইন এর মাধ্যমে গ্রহন করে।
লিভার এর সাথে আরেকটি ছোট গ্রন্থি আছে যার নাম পিত্তথলি। পিত্তথলি, পিত্তরস তৈরী করে যা ফ্যাট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভেঙ্গে দেয়, যাতে ক্ষুদ্রান্তে খুব সহজেই হজম হয়।
লিভার বা যকৃতের ভূমিকাঃ
শরীরে লিভারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, যা শরীরকে স্বাভাবিক রাখে। এগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
* গ্লাইকোজেন সংরক্ষণ করে, যা গ্লুকোজ (চিনি) ভাঙ্গে এবং শরীরে শক্তির প্রয়োজনে স্রোতের মধ্যে মুক্ত হয়।
* চর্বি এবং প্রোটিন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।
* প্রোটিন তৈরী করে যাতে রক্ত জমাট বাধঁতে সহায়তা করে।
* এলকোহল, ড্রাগ এবং বিষক্রিয়া অপসারণ প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।
* পিত্তরস তৈরী করে যা জারিত খাদ্য চর্বিতে রুপান্তর করে।
ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (FLD):
আমরা শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় যদি অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহন করি, তা শরীরে ফ্যাট বা চর্বি হিসেবে জমে। লিভার অতিরিক্ত ক্যালরিকে চর্বিতে রুপান্তর করে, যা রক্তের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন কোষে জমা হয়। ঠিক এভাবেই যখন লিভারে ট্রাইগ্লিসারাইড, ফসফোলিপিড, কোলেস্টেরল ও ফ্যাট জমা হয়ে এর নিজস্ব ওজনের ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ বেশি চর্বি দিয়ে পূরণ হলে তাকে ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বলে। এই প্রক্রিয়াকে স্টিয়াসিসও বলে। এ রোগটি মধ্য বয়সী মহিলাদের মধ্যেই বেশি দেখা দেয়, পুরুষদেরও হতে পারে।
চর্বিযুক্ত লিভার রোগ মূলত দুই ধরণেরঃ
১) এলকোহলিক লিভার ডিজিজ ( ALD )
২) অ-এলকোহলিক লিভার ডিজিজ ( NAFLD )
এছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে লিভার রোগ হতে পারে।
১) এলকোহলিক লিভার ডিজিজ ( ALD ):
অতিরিক্ত পরিমাণে এলকোহল সেবন করলে এলকোহলিক লিভার রোগ হতে পারে । এটা এলকোহল সেবনের কিছু সময় পরেও হতে পারে । এলকোহল সেবনকারীর বাবা মা এলকোহল সেবনকারী থাকলে, তিনি জীনগত কারণে দ্রুত এলকোহলিক লিভার রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
এছাড়াও নিম্নোক্ত বিষয়ও এলকোহল সেবনকারীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেঃ
* হেপাটাইটিস সি ( যা লিভারে প্রদাহ তৈরী করতে পারে )
* শরীরে অতিরিক্ত লৌহ ( Iron ) থাকলে
* মেদ বেশী থাকলে
২) নন-এলকোহলিক লিভার ডিজিজ ( NAFLD )
অ-এলকোহলিক লিভার রোগের মূল কারণ স্পট নয়। এটা জীনগত ভাবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছড়ানোর একটা প্রবনতা আছে। এটি বেশির ভাগ মধ্য বয়সী, অতিরিক্ত ওজন অথবা মেদবহুল মানুষের বেশি হয় । উচ্চ কোলেস্টেরল এবং ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগীদেরও এই রোগটি বেশি দেখা দেয় ।
অন্যান্য কারণঃ
* ওষুধ প্রয়োগ (Medications) যথা- স্টেরয়েড (Cortice-steroids), টেট্রাসাইক্লিন (Tetracycline) এবং কার্বন টেট্রাক্লোরাইড (Carbon tetrachloride), প্যারাসিটামল মেথট্রাক্সেড, হেলোথ্যান এনাস্থেসিয়া, ফসফরাস পয়জনিং ইত্যাদি ।
* অটোইমিউন বা বংশগত লিভার রোগ
* খুব দ্রুত ওজন কমে যাওয়া
* পুষ্টিহীনতা
* রেইস সিন্ড্রোম (এনসেফালাইটিস-সহ ফ্যাটি লিভার)
* প্রেগন্যান্সি সময়ে তীব্র ফ্যাটি লিভার
* বংশগত হাইপারলিপিডেমিয়া
* কাশিং সিন্ড্রোম
* কিছু জরীপে দেখা গেছে যে, ক্ষুদ্রান্তে অতিরিক্ত ব্যকটেরিয়া থাকলে এবং ক্ষুদ্রান্তের অন্যান্য কিছু প্ররিবর্তনের সাথে নন - এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার রোগের সম্পর্ক আছে।
ফ্যাটি লিভারের চিহ্ন এবং লক্ষণসমূহঃ
ফ্যাটি লিভার রোগ হলে স্বাভাবিক ভাবে বুঝা যায় না। প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না । বেশ সময় , প্রায়ই বছর পরে অথবা যখন
লিভারে বেশ ক্ষতি হয়ে যাবে, তখন নিচের সমস্যাগুলো বুঝতে পারেনঃ
১) ক্লান্তি অনুভব হবে
২) ওজন অথবা ক্ষুদা কমে যাবে
৩) শরীর দূর্বল লাগবে
৪) বমি বমি লাগবে, এবং বমি হতে পারে
৫) বিভ্রান্তি (Confusion), সিদ্ধান্তহীনতা (poor judgment), অথবা মনোযোগে সমস্যা চলে আসবে (trouble concentrating)
৬) জন্ডিস দেখা দিতে পারে
৭) শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পানি আসতে পারি
৮) লিভার বড় এবং স্পর্শকাতর হবে
আরও কিছু সমস্যা আসতে পারে, তাহলো লিভার বড় হতে পারে। পেটের উপরিভাগের ডানদিকে অথবা পেটের মধ্যে ব্যাথা হতে পারে। এমনকি ঘাড়ে ও বাহুর নিচে গাড় রঙের দাগ পড়তে পারে।
এলকোহলিক লিভার ডিজিজ রোগীদের ক্ষেত্রে, এলকোহল সেবন কালে উপরের লক্ষণগুলি আরোও বেশি দেখা দিতে পারে।
ডায়াগনোসিস ফ্যাটি লিভার ডিজিজঃ
* রুটিন চেকআপ এর সময় আপনার ডাক্তার লিভার তুলনামূলক ভাবে বড় দেখতে পারেন।
* রক্ত পরীক্ষা। ফ্যাটি লিভারে নির্দিষ্ট কিছু এনজাইম বেশি পরিমাণে থাকতে পারে।
* আলট্রাসনোগ্রাম। এতে শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে লিভারের ছবি পেতে পারেন।
কনফার্ম ডায়াগনোসিসঃ
বায়োপসি। নির্দিষ্ট স্থান অবশ করে, আপনার ডাক্তার নিডল এর মাধ্যমে সামান্য লিভারের অংশ নিয়ে অণুবীক্ষন যন্ত্রের মাধ্যমে ফ্যাট, প্রদাহ, এবং নষ্ট লিভারের কোষ দেখতে পারেন।
* এলবুমিন কিছু ক্ষেত্রে কমে যাবে
* গ্লোবিউলিন যথারীতি বাড়বে
* কোলেস্টেরল যথারীতি বাড়বে
* টোটাল বিলিরুবিন যথারীতি বাড়বে
* এলকালাইন ফসফেটেজ যথারীতি বাড়বে
* ট্রান্স-এমিনেজ যথারীতি বাড়বে
* প্রোথমবিন টাইম দীর্ঘ হবে।
এছাড়াও রক্তশুন্যতা, শ্বেত রক্ত কনিকা বেড়ে যাবে, প্রস্রাবে এলবুমিন বেড়ে যাবে, রক্তে সুগার বেড়ে যাবে অথবা কমে যাবে, এবং লৌহ, ফলিক এসিড, ভিটামিন বি১২ এর অভাবজনিত সমস্যা দেখা দিবে।
ফ্যাটি লিভার রোগ প্রতিরোধে করণীয়ঃ
একটি স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন পদ্ধতির মাধ্যমে স্থূলতা প্রতিরোধ করা যায়। যা 'ফ্যাটি লিভার' রোগের প্রধান কারণ। মনে রাখতে হবে স্বাস্থ্যকর খাবার এবং
নিয়মিত ব্যায়াম দৈহিক ওজন হ্রাসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধের উপায়ঃ
* স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
* অতিরিক্ত ওজনের ক্ষেত্রে, ধীরে ধীরে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে ওজন কমাতে হবে। এক সপ্তাহে ১ বা ২ পাউন্ডের উপর ওজন কমানো যাবে না।
* সূষম খাদ্য খেতে হবে যাতে সম্পৃক্ত চর্বির (Fat) পরিমাণ অল্প এবং তন্তু জাতীয় খাবারের (Fibre food) পরিমাণ বেশি থাকে।
* নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। এতে নিয়মিত হাঁটা, সাইকেল চালনা, সাঁতার কাটা, বাগানে কাজও হতে পারে।
* প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা ব্যায়াম করতে হবে।
* ধুমপান, মদ বা অ্যালকোহল এড়িয়ে চলতে হবে।
* অতিরিক্ত শর্করা খাবার যথা - অতিরিক্ত ভাত, অতিরিক্ত রুটি, অতিরিক্ত আলু এড়িয়ে যেতে হবে, কারণ অতিরিক্ত শর্করা লিভারে চর্বি হিসেবে জমে।
* লাল মাংস, ডিমের কুসুম এড়িয়ে চলতে হবে।
* ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড বা ভারী খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
* অতিরিক্ত ফ্রুক্টোজ যুক্ত খাবার যথা- কোকাকোলা, সেভেন আপ, কৃত্রিম জুস, সস ত্যাগ করতে হবে ।
* ট্রান্সফ্যাট যুক্ত খাবার যথা- অতিরিক্ত তেলে ভাজা, ঘি দিয়ে তৈরী খাবার ত্যাগ করতে হবে।
* ডায়াবেটিস থাকলে অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রণ করা ।
* কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণ করা ।
ফ্যাটি লিভারের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাঃ
হোমিওপ্যাথি সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। ব্যক্তিস্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে এবং সদৃশ্য উপসর্গ এর উপর ভিত্তি করে ওষুধ নির্বাচনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। এটি রোগীর সব চিহ্ন এবং উপসর্গ মুছে পূর্ব স্বাস্থ্যে ফিরে আসার একমাত্র পদ্ধতি। হোমিওপ্যাথির লক্ষ্য শুধুমাত্র ফ্যাটি লিভার উপসর্গের চিকিৎসা নয়, তার অন্তর্নিহিত কারণ এবং স্বতন্ত্র প্রবণতা মোকাবেলাও এর প্রধান কাজ। স্বতন্ত্র ঔষধ নির্বাচন এবং সু-চিকিৎসার জন্য রোগীকে অবশ্যই একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ও রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। ফ্যাটি লিভার উপসর্গের চিকিৎসার জন্য সহায়ক ওষুধগুলি নিম্নরুপঃ
আর্সেনিক এলবাম, নাক্স ভমিকা, চেলিডোনিয়াম, কার্ডোয়াস মেরিনাস, এপোসাইনাম, লাইকোপোডিয়াম, সেপিয়া, ফসফোরাস, ডিজিটালিস, ব্রায়োনিয়া, হেলেবোরাস নাইজার, ফেরাম মেট, ক্যালি কার্ব, আইরিস ভার্স, ন্যাট্রাম কার্ব এবং আরোও অন্যান্য ওষুধ।
শেষ কথাঃ
ফ্যাটি লিভার ডিজিজ রোগীরা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসতে পারে, যদি তিনি চিকিৎসার পাশাপাশি সঠিকভাবে সুষম খাবার গ্রহণ এবং সচেতনতার সাথে জীবন শৈলির একটু পরিবর্তন করেন। আর যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তাহলে স্থায়ীভাবে লিভার নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
Post a Comment
Post a Comment