গনোরিয়া বা প্রমেহ এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। গনোরিয়া বা প্রমেহ হলো এসটিআই বা যৌনবাহিত রোগ। স্ত্রী বা পুরুষদের প্রস্রাবনালীর অভ্যন্তরস্থ শ্লৈষ্মিক ...
গনোরিয়া বা প্রমেহ এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা।
গনোরিয়া বা প্রমেহ হলো এসটিআই বা যৌনবাহিত রোগ। স্ত্রী বা পুরুষদের প্রস্রাবনালীর অভ্যন্তরস্থ শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির প্রদাহ হয়ে সেখান থেকে পুঁজেরমত স্রাব নিঃসৃত (Discharge) হলে তাকে প্রমেহ বা গনোরিয়া রোগ বলে। এটি ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে সংক্রামিত হয়।
রোগটি প্রথমে পুরুষের মূত্রনালীর পিছনের গর্ত ফসা-ন্যাভিকিউলারিস (Fosa nevicularis) নামক স্থানে আরম্ভ হয়ে ধীরে ধীরে মূত্রনালী, মূত্রথলি ও অন্ডকোষ আক্রান্ত হয়। নারীদের ক্ষেত্রেও মূত্রনালী (Urethra), মূত্রথলী (Urinary Bladder), জরায়ু (Uterus), ফ্যালোপিয়ান টিউব (Fallopian tube) ইত্যাদি আক্রান্ত হয়।
আর শিশুদের ক্ষেত্রে গনোরিয়াগ্রস্ত মায়ের পেট থেকে সন্তান হবার সময় ইহার পুঁজ সন্তানের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন- চোখ, গলা, জয়েন্ট ইত্যাদিতে আক্রমণ করে।
গনোরিয়া বা প্রমেহ এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। |
গনোরিয়া কারণ:
গনো-কক্কাস এর নেসেরিয়া গনোরিয়া (Neisseria gonorrhoeae) নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা রোগটি হয়ে থাকে। এটি সংক্রামক রোগ। সিফিলিসের রোগের মত এটিও গনোরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সেক্সুয়াল কন্টাক্ট দ্বারা সংক্রমিত হয়। বিশ্বব্যপি প্রায় ২০-২৫ কোটি লোক গনোরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।গনোরিয়া কীভাবে ছড়ায়?
শতকরা ১০-১৫ ভাগ পুরুষ উপসর্গবিহীন অবস্থায় (Symptom-less stage) থাকে। এদিকে শতকরা ৫০-৭৫ ভাগ মহিলাই উপসর্গবিহীন (Symptom less) অবস্থায় থাকলেও তাদের জরায়ু (Uterus) জীবাণু বহন করে এবং প্রদাহ (Inflammation) সৃষ্টি করে।এ কারণে একজন যৌনকর্মীর (Sex worker) সংস্পর্শে প্রতিদিন যে কয়জন পুরুষ মেলামেশা করে সবাই গনোরিয়াতে আক্রান্ত (Gonorrhea infection) হলেও যৌনকর্মীর কোনরূপ অসুবিধা হয় না। মুখমেহনের মাধ্যমে রোগীর গলার ভেতরের অংশকে আক্রান্ত করে।
এতে গলা ব্যথা বা ঘন পুঁজের মতো কাশি হতে পারে। পায়ুপথে মেলামেশার মাধ্যমে মলদ্বার ও রেকটামে প্রদাহ হয়। প্রসবের সময় মা গনোরিয়া দ্বারা আক্রান্ত থাকলে শিশুর চোখ গনোরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অসাবধানতাবশত জীবাণুযুক্ত (Germ) পরিধেয়, তোয়ালে (Towel) ব্যবহার করলে বা গনোরিয়ায় আক্রান্ত কারো দ্বারা ধর্ষিত (Rape) হলে বাচ্চাদের যোনিপথে প্রদাহ দেখা দেয়।
গনোরিয়া রোগ প্রকাশের সময়:
পুরুষদের ক্ষেত্রে ৩-১৪ দিন। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সময় আরো একটু বেশি। সাধারণত জীবাণু সংক্রমণের পরে ১-৩ সপ্তাহের মধ্যে রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায়। অনেক মেয়েদের যৌনাঙ্গে জীবাণুদের সংক্রমণ ঘটলেও তারা লক্ষণ বিহীন বাহক হিসেবে অনেক সপ্তাহ বা মাস রয়ে যায়।গনোরিয়া রোগের লক্ষণ:
* বার বার মূত্র ত্যাগের ইচ্ছা (Frequent micturation)। মূত্র ত্যাগকালে জ্বালাপোড়া করে।* প্রস্রাবের পথ কিট কিট করে কামড়ায়।
* জনন ইন্দ্রিয়ে প্রদাহ, এ থেকে পুঁজ পড়ে। যৌনাংগে ব্যথা, সূচীবিদ্ধ যন্ত্রণা।
* মূত্রনালী চুলকায়, সুড়সুড় করে প্রথমে জলেরমত পড়ে সাদা ও হলদে পুঁজ নির্গত হয়। সর্বদাই ঝরতে থাকে (Secretion), জামা কাপড়ে চটচটে দাগ (Spot on cloth) পড়ে।
* পুরুষাঙ্গের ভিতরের নালীতে এবং মুখের কাছে এবং নারীদের মূত্রনালী ও যোনির চারপাশে ক্ষত হয়। ধীরে ধীরে চার দিকে বিস্তৃত হয়।
* সময়মত চিকিৎসা না করলে মূত্রনালী অবরুদ্ধ (Obstruction) হয়ে যায়। সরু ধারায় মূত্র বের হয় এবং তা কষ্টকর হয়। আনন্দহীন সংগম (Pleasure less sex) এবং নিদ্রাকালে স্বপ্নে (Night pollution) শুক্র ক্ষরণ হয়। এছাড়া পরে বাত (Gout), হৃদরোগ (Heart disease), স্নায়ুশুল, চোখের রোগ(Eye disease) প্রভৃতি দেখা দিতে পারে।
গনোরিয়া বা প্রমেহ এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা।
* রোগ পুরাতন হলে (Chronic) পুজ পড়া (Puss), জ্বালা পোড়া (Burning), সুড়সুড় করা, ব্যথা (Pain) প্রভৃতি থাকে।* জীবাণু চোখকে আক্রমণ (Eye infection) করলে চোখের যন্ত্রনা হয়। অবিরাম পুজ পড়ে (Puss discharge), চোখের পাতা ফুলে ওঠে (Swelling)।
* লিঙ্গ-মুখ আরো স্ফীত ও লাল হয়ে ওঠে এবং প্রবল স্পর্শ কাতর হয়। লিংগ উত্থান কালে ভয়ানক কষ্ট হয়। লিংগ উত্থানের এই কষ্টকর অবস্থাকে কর্ডি বলে। কুঁচকীর গ্লান্ডগুলো প্রদাহ (Gland infection) হয়ে ফুলে ও ব্যথা হয় এবং ক্ষতের সৃষ্টি হয়। একে বাগী বা বিউবো (Bubo) বলে।
* মলদ্বার (Rectum) ও পেরিনিয়ামে (Perineum) দপদপানি ও টাটানি যন্ত্রনা হয়।
* গ্লিট বা ক্রনিক (Chronic) অবস্থায় যদি প্রস্টেট গ্লান্ডের (Prostate gland) প্রদাহ জড়িত থাকে তা হলে প্রস্রাব করার সময় (During micturation) অনেকক্ষণ বসে বা দাড়িয়ে থাকতে হয়। সহজে প্রস্রাব হয় না, অল্প অল্প ফোঁটা ফোঁটা পড়ে অথচ বেগ লেগেই থাকে এবং সমগ্র মুত্রনালী, পেরিনিয়াম ও কোমরে দপদপানি যন্ত্রণা থাকে।
গনোরিয়া জটিলতাঃ
প্রাথমিক অবস্থায় (Early stage) চিকিৎসা করলে এ রোগ সহজেই নির্মূল হয়। কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসা (Proper treatment) বা সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে নানারকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। শুক্রনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, উপ-শুক্রাশয় (এপিডাইডাইমিস) নষ্ট হয়ে যেতে পারে।ফলে যৌনরসে বীর্যকোষ থাকে না, যার ফলে ওই ব্যক্তি সন্তানের পিতা হতে পারে না। রোগটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ফলে সে যার সঙ্গে দৈহিক মেলামেশা করবে সেই এই রোগে আক্রান্ত হবে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার ফলে প্রস্টেটগ্রন্থির প্রদাহ হতে পারে। ফলে প্রস্রাব আটকে যায় বা বন্ধ হয়।
গনোরিয়া রোগ নির্ণয়ঃ
এক্ষেত্রে রোগীর বিস্তারিত ইতিহাস (History) শুনতে হবে। সে এরই মধ্যে কোনো যৌন সম্পর্ক (Sex act) স্থাপন করেছিল কি-না প্রশ্ন করে ভালো করে উত্তর পেতে হবে। সম্পর্ক থাকলে তা কতদিন আগে এবং কত জনের সঙ্গে। এসব জেনে নিতে হবে। তারপর পরীক্ষা করতে হবে।যদি স্বল্পস্থায়ী আক্রমণ (Acute) হয়ে থাকে তাহলে পুরুষের ক্ষেত্রে প্রস্রাবের রাস্তা (Urethra) থেকে নিঃসরিত পুঁজ বা পদার্থ (Discharge) এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে মূত্রনালি (Urethra) ও জরায়ু (Uterus) নিঃসরিত পদার্থ পরীক্ষা করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি (Chronic) হলে প্রস্টেটগ্রন্থি ম্যাসাজের পর নিঃসরিত পদার্থ (Prostate fluid) পরীক্ষা করতে হবে কিংবা সকালের প্রথম ফোঁটা প্রস্রাবও (First drop of urine) পরীক্ষা করা যেতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ু নিঃসরিত বস্তু পরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়াও কালচার ও সেনসিটিভিটি পরীক্ষা করা যেতে পারে।
গনোরিয়া কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়:
যে কোন সংক্রমণ প্রতিরোধের (Protect infection) সবচেয়ে সুনিশ্চিত উপায় হল যৌনসংসর্গ এড়িয়ে (Avoid illegal sex) যাওয়া অথবা পারস্পরিক বোঝাপড়ায় যৌনসংসর্গের জন্য একটিমাত্র সঙ্গী বেছে (Select valid sex partner) নেওয়া, যার কোন যৌনসংক্রমণ নেই৷ মোট কথা, ইসলামী আইন মেনে চললেই গনোরিয়া প্রতিরোধ করা যাবে।গনোরিয়া বা প্রমেহ এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাঃ
গনোরিয়া রোগ চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথিতে অত্যন্ত ফলদায়ক ঔষধ আছে, যা অন্য কোন প্যাথিতে নেই। নির্দিষ্ট মাত্রায় লক্ষণভেদে ঔষধ প্রয়োগে এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় (Cure) করা সম্ভব। চিকিৎসার জন্য অবশ্যই একজন যোগ্যতাসম্পন্ন (BHMS) হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
গনোরিয়া বা প্রমেহ এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ব্যবহৃত রবিন মার্ফির রেপার্টরির বিভিন্ন ঔষধ নিম্নরুপঃ
১ম গ্রডঃ ক্যানাবিস স্যাট, থুজা, মেডোরিনাম।
২য় গ্রেডঃ সিপিয়া, পালসেটিলা, সালফার, একোনাইট, ক্যাপসিকাম, ক্লিমেটিস, জেলসেমিয়াম, হাইড্রাস্টিস, ক্যালি বাই, মার্ক কর, পেট্রোসেলেনিয়াম, এসিড নাইট্রিক, এসিড ফু্লরিক, মার্কসল, সাইলিশিয়া, আর্জেন্ট মেট, আর্জেন্ট নাইট্রিকাম, সিনেবেরিস, মেজোরিয়াম, এসিড ফম, ক্যান্থারিস, কোপাইভা, কিউবেবা অফিসিনালিস।
৩য় গ্রেডঃ এলুমেন, এগ্নাস কাস্ট, এপিস মেল, এসিড বেঞ্জায়িক, হিসার সালফ, ক্রিয়োজুট, ক্যালি সালফ, ন্যাট্রাম সালফ, স্যাবাল সেরু, স্যাবাইনা, টেলুরিয়াম, জিঙ্ক।
[বিঃদ্রঃ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান ব্যতীত ওষধ সেবন করা উচিত নয়।]
COMMENTS