ডাঃ রাজন শংকরণের হোমিওপ্যাথির সেনসেশান মতবাদ Sensation method of Homeopathy part - 1 বর্তমান সময়ের যে কয়েকজন শীর্ষ হোমিওপ্যাথ...
Sensation method of Homeopathy part - 1 |
বর্তমান সময়ের যে কয়েকজন শীর্ষ হোমিওপ্যাথ, হোমিওপ্যাথি নিয়ে মৌলিক চিন্তা করেন, ডাঃ রাজন শংকরণ তাদের মধ্যে অন্যতম। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ডাঃ জেমস টাইলার কেন্টের ১৯১৬ সালে মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন যাবৎ হোমিওপ্যাথিতে একটি স্থবির (Plateau) অবস্থা বিরাজ করছিল। আজ থেকে ২০/২৫ বছর পূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে হোমিওপ্যাথি নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধানের বা গভীর পর্যবেক্ষণের বা নবজাগরণের সূচনা হয় (The renaissance of Homoeopathy)। গ্রীসের ডাঃ জর্জ ভিথোলকাস এই গভীর অনুসন্ধানের বা পর্যবেক্ষণের বা নবজাগরণের বা রেনেসাঁর (renaissance) একজন মহান সূচনাকারী। অন্যান্য মনীষীরা হলেন - ইউজেনিও এফ কান্দেজেব, থমাস পাবলো পাচেরো, পি এস ওর্তেগা, এলফনসো মাসী ইলিজালডি, জারগেন বেকার, জেরেমী শের, জন স্কোলটেন, এম. এল. সেগাল, রাজন শংকরণ, জোসেফ রিভস, মাছিমো ম্যাংগিএলাভোরি প্রমুখ হোমিওপ্যাথগণ সহ আরও অনেকে গভীর ভাবে হোমিওপ্যাথিকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন, নতুন ধরনের চিন্তাধারার মাধ্যমে আরও সূক্ষ্মভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য আগত রোগীকে ওষুধ নির্বাচনের পথ দেখান। বিভিন্ন মনীষীদের দেখানো বিভিন্ন মত বা পথ হোমিওপ্যাথিক জগতে মায়াজম, ওষুধ স্টাডি, রোগী পর্যবেক্ষণ, রোগী-লিপি তৈরি, হোমিওপ্যাথির দর্শন, রেপার্টরীর ব্যবহার পদ্ধতি ইত্যাদি সহ বহুবিধ ক্ষেত্রে নতুন ধরনের ব্যাখ্যা, নতুন দিক নির্দেশনা দান করে এবং একই সাথে নানা রকমের বিতর্কেরও সৃষ্টি করে। এমনই একজন পথ নির্দেশক ও নতুন ব্যাখ্যা প্রদানকারী চিকিৎসক হচ্ছেন ডাঃ রাজন শংকরণ। বর্তমান বিশ্বে প্রথম শ্রেণীর হোমিওপ্যাথদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তাঁর “সেনসেশন মেথড (Sensation Method)” মতবাদের কারণে তিনি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি হ্যানিম্যান উদ্ভাবিত হোমিওপ্যাথিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন এবং ওষুধের কেন্দ্র অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন। তিনি হোমিওপ্যাথির একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষক, সারা বিশ্বে তিনি সেমিনারের মাধ্যমে তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতি ও হোমিওপ্যাথি শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর দেয়া এই মতবাদকেই তিনি ওষুধ নির্বাচনের সেনসেশান মেথড (Sensation Method) বলে নামকরণ করেছেন। Sensation শব্দটির বাংলা আভিধানিক অর্থ হচ্ছে – অনুভব করবার শক্তি, সংবেদন, ইন্দ্রিয়-বোধ, অনুভূতি, দৈহিক বা মানসিক বোধ বা অনুভূতি, ভাবাবেগ ইত্যাদি। সহজভাবে বাংলায় ডাঃ রাজন শংকরণের এই মতবাদকে সংবেদন পদ্ধতি বলতে পারি। এই গবেষকের গবেষণালব্ধ উদ্ভাবনের কিছু নমুনা আজ আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব। বহু কথাই তারপরেও বাদ থেকে যাবে, আশি করি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
যদি আপনার মনে হয় ডাঃ রাজন শংকরণ এর মতবাদ বা ধারণা হোমিওপ্যাথির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তাহলে তা অবশ্যই বর্জন করবেন, আর যদি মনে করেন তাঁর মতবাদ ওষুধের কেন্দ্র অনুসন্ধানে সহায়তা করে, সদৃশ ওষুধ নির্বাচন নীতিকে আরও গভীরভাবে প্রয়োগ করে, ওষুধ নির্বাচনকে আরও জোরালো করে, রোগী ক্ষেত্রে অধিকতর সদৃশতা দান করে, তাহলে ধরে নিতে পারেন তাঁর মতবাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে, তারপর পরীক্ষামূলক-ভাবে সেটি প্রয়োগ করে দেখবেন, উপকার হয় না অপকার হয়।
রাজন শংকরণের সেনসেশান মেথড এর মূল কথা হচ্ছে –
(১) রোগীর মায়াজমেটিক অবস্থার সদৃশ ওষুধ নির্বাচন করতে হবে।
(২) হোমিওপ্যাথিক ওষুধের চারটি প্রধান উৎসের Kingdom হচ্ছে – প্রাণীজ, উদ্ভিজ্জ, খনিজ এবং রোগজ। রোগীর যে জগতের বা Kingdom এর সবচেয়ে বেশী সদৃশতা থাকবে সেই জগতের উৎস অনুসারে ওষুধ নির্বাচন করতে হবে।
(৩) রোগীর রোগাবস্থার গভীরতা ও রোগীর জীবনী শক্তির গ্রহণ ক্ষমতা যাচাই করে ওষুধের শক্তি নির্বাচন করতে হবে।
(৪) রোগীর জন্য চূড়ান্ত ওষুধ নির্বাচন করার সময় মায়াজমেটিক অবস্থা ও ওষুধের উৎসের বৈশিষ্ট্যের অর্থাৎ এই উভয় বৈশিষ্ট্যের সদৃশতা যে ওষুধে পাওয়া যাবে সেটিই হবে সেই রোগীর জন্য নির্বাচিত ওষুধ।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান আমাদের শিখিয়েছেন, রোগাক্রমণের মূল বা মৌলিক কারণ মায়াজম (MIASM)। এই মায়াজম হচ্ছে- সোরা, সিফিলিস এবং সাইকোসিস। পরবর্তী সময়ে অন্য এক মনীষী জে. এইচ. এলেন যোগ করলেন ও ব্যাখ্যা করলেন আরও একটি মায়াজম, যার নাম দিলেন টিউবারকুলোসিস। এই চারটি মায়াজমেটিক অবস্থা আমাদের হোমিওপ্যাথদের কেউ কেউ খুবই গুরুত্ব দেন, আবার কেউ কেউ হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথিক ধারার চিকিৎসক হয়েও মায়াজম তত্ত্বকে গুরুত্ব দেন না। এরূপ অবস্থায় ডাঃ রাজেন শংকরণ হোমিওপ্যাথিতে যোগ করতে চেষ্টা করেন আরও কয়েক প্রকারের মায়াজম ও নতুন ধরনের ব্যাখ্যা, যাতে করে ওষুধের কেন্দ্র অনুসন্ধান আরও গভীর হয় এবং রোগীর ওষুধ নির্বাচন আরও সঠিক হয়। হ্যানিম্যান ক্রনিক ডিজিজ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন - সতর্কতার সাথে নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও রোগ সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হচ্ছেনা, রোগ বেড়ে যাচ্ছে বা কিছু দিন ভাল থেকে আবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বা নতুন রূপে প্রকাশিত হচ্ছে (সূত্র - ক্রনিক ডিজিজ ১৩-১৪). দীর্ঘ দুই বৎসর দিবা-রাত্র অমানুষিক পরিশ্রম করে এই সমস্যার সমাধান হ্যানিম্যান করতে সক্ষম হলেন এবং আবিষ্কার করলেন যে সোরা, সিফিলিস, সাইকোসিস মায়াজমত্রয় এসকল রোগের মূল কারণ।পরবর্তীতে তিনি তাঁর ব্যর্থ কেইসগুলো চিকিৎসার জন্য যে সকল ওষুধকে চিহ্নিত করেন, সেগুলোই হচ্ছে এন্টি মায়াজমেটিক ওষুধ। এই নব আবিষ্কৃত জ্ঞান হ্যানিম্যানকে আরও বেশী সফলতা এনে দেয়, ব্যর্থ কেইসগুলোও নিরাময়যোগ্য হয়ে আরোগ্য লাভ করতে থাকে এবং তিনি এই জ্ঞান মানব জাতীর কল্যাণে অর্গানন অব মেডিসিন গ্রন্থে, মেটেরিয়া মেডিকা গ্রন্থে এবং ক্রনিক ডিজিজ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে লিখে আমাদের জন্য রেখে গেলেন। হ্যানিম্যানের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইতিমধ্যে বহু সময় অতিবাহিত হয়েছে, খ্যাতিমান হোমিও মনীষীরা অভিজ্ঞতার দ্বারা দেখতে পেলেন যে, কোন কোন ক্ষেত্রে হ্যানিম্যান বর্ণিত মায়াজম্যাটিক থিউরি প্রয়োগ করেও রোগীকে আশানুরূপ আরোগ্য দেয়া যাচ্ছে না। কেন এরূপ হচ্ছে, এর সমাধানই-বা কি এই প্রশ্ন থেকেই বর্তমানে নানা রকম মতবাদের উদ্ভব হয়েছে এবং আমরা এই প্রজন্মের হোমিওপ্যাথরা হ্যানিম্যান ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ এর পক্ষ থেকে এ সকল মতবাদকে জানার ও বুঝার চেষ্টা করছি। মনীষীরা আমাদের বলেন তুমি যখন প্রচলিত ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথিক ধারনা দিয়ে চিকিৎসায় ব্যর্থ হও বা আশানুরূপ ফলাফল পাওনা, তখন নিরাশ না হয়ে রোগীকে নিয়ে আরেকটু গভীর ভাবে চিন্তা কর, তখন তুমি বিভিন্ন পদ্ধতি, বিভিন্ন দর্শন ইত্যাদিতে অনুসন্ধান করতে পার এবং যে পদ্ধতি বা যে দর্শন তোমার নিকট সবচেয়ে ভাল মনে হয় সেটি তোমার রোগীর ক্ষেত্রে, তোমার স্টাডির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখ, আশা করি ভাল একটা ফলাফল তুমি পেয়েও যেতে পার। বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডার অনেক বিশাল, তুমি হোমিওপ্যাথির মূলনীতিকে অক্ষুণ্ণ রেখেও তোমার ব্যর্থ কেইসগুলোকে নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার সুযোগ পাবে। তুমি তোমার জানার ঘরকে কারাগার করে ফেলনা, খোলা আকাশের দিকে তাকাও, জ্ঞানও সেরূপ বিশাল। কোন কিছুকেই অবজ্ঞা করোনা। হিমালয়ের চূড়ায় উঠার অনেক রাস্তা আছে। চূড়ায় উঠে যদি নীচের দিকে তাকাও দেখবে নীচের সবগুলো পথই চূড়ার দিকে আসার রাস্তাকেই নির্দেশ করছে।
ডাঃ রাজন শংকরণের মায়াজম সম্পর্কিত মতবাদ
রাজন শংকরণের মায়াজম সম্পর্কিত চিন্তাধারাতেই রয়েছে সেনসেশান মতবাদের মূল কনসেপশান, সুতরাং এবার আমরা প্রচলিত মায়াজমের বিশেষ নির্দেশনাকে এক নজরে দেখে নেব, তা’হলে রাজন শংকরণের সেনসেশান মতবাদটিকে বুঝতে সুবিধা হবে। আমাদের শ্রদ্ধাভাজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও হোমিও মনীষীদের গবেষণার কল্যাণে এখন আমরা রোগীদের দেয়া লক্ষণাবলীর দ্বারাই মায়াজমের মূলসুরটি ধরতে পারি, যেমন-
১. সোরা (PSORA): কেবলমাত্র ক্রিয়াগত পরিবর্তন সাধন করে, গঠনগত কোন পরিবর্তন আনয়ন করতে পারে না (Only functional change, No structural change)। মানসিক দিক দিয়ে আত্মরক্ষামূলক মনোভাবের (Defensive attitude)।
২. সিফিলিস (SYPHILIS): গঠনগত পরিবর্তন সাধন করে সকল প্রকার কোষকে বিধ্বস্ত করে, ফলে ক্ষত বা আলসার হয়, স্রাব হয়, হাড়ের বিকৃতি ঘটে। (Must be Structural change and Destruction)। মানসিক দিক দিয়ে ধ্বংসাত্মক মনোভাবের (Destructive attitude)।
৩. সাইকোসিস (SYCOSIS): গঠনগত পরিবর্তন সাধন করে। কোষকলার অসম বৃদ্ধি হয়, ফলে আঁচিল, টিউমার, মোটা বা স্থূল কোষকলার সৃষ্টি হয়। (Must be Structural change and Overgrowth)। মানসিক দিক দিয়ে আক্রমণাত্মক মনোভাবের (Aggressive attitude)।
আবার, অন্য ভাবেও মায়াজমের মূলসুর হতে পারে, যেমন-
১. সোরার কমতি বা ঘাটতি (lack or want or scanty or deficiency)
২. সিফিলিটিকের ধ্বংসাত্মক অস্বাভাবিকতা (Destruction or Perversion or Dissolution or Degeneration)
৩. সাইকেটিকের অ-সমন্বয় বা অসংযমী বা মাত্রাধিক্য বা বাড়তি বা সংখ্যাবৃদ্ধি (Inco-ordination or intemperance or excess or a proliferation of tissues)
৪. টিউবারকুলারের ক্ষয়মূলক বিধ্বংসী কার্যকলাপ (Waste. Loss. Depreciation and Destruction.)
৫. ক্যান্সার এর অপকর্ষতা ও কোষকলার নিয়ন্ত্রণ-হীন অসীম বৃদ্ধি (Malignancy and Unlimited power of proliferation )
৬. এইডস (AIDS) এর স্বোপার্জিত কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব (Acquired immuno- deficiency syndrome) ইত্যাদি অস্বাভাবিকতা সমূহ দ্বারা আমরা এখন আরও সঠিকভাবে ও নির্ভুলভাবে মায়াজমকে সনাক্ত করতে পারি এবং এদের পারস্পরিক সম্পর্ক উপলব্ধি করতে পারি।
রোগ সম্পর্কে রাজন শংকরণের নিজস্ব ধারণা হচ্ছে – “রোগ হল বাস্তবতার এক ধরনের মিথ্যা উপলব্ধি- একটি বিভ্রান্তি বা মতিভ্রম” (disease is a false perception of reality... a delusion.) যা থাকে রোগীর দেহে বা মনে অথবা পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত হয়। এই বিভ্রান্তি রোগীর সমগ্র ব্যক্তিসত্তা জুড়েই থাকে, দেহ এবং মন সবখানেই, কেবল মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। রোগীর মানসিক স্তর, শারীরিক স্তর এবং প্যাথলজি সব কিছুতেই মায়াজমের অস্তিত্ব থাকে।
এই মায়াজম একটি রোগী-লিপির ভাব জোরালো ভাবে প্রকাশ করে দেয়। আমাদের কাজ হচ্ছে এই মতিভ্রম বা বিভ্রান্তিকে উপযোগী আচরণ দিয়ে শ্রেণীবিভাগ করা বা ব্যাখ্যা করা (Adaptive behavior)।
এখানে হ্যানিম্যানের মায়াজম তত্ত্বের সাথে রাজন শংকরণের তত্ত্বের কোন বিরোধ আমি দেখিনা। যদিও প্রকাশের ভাষায় কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। হ্যানিম্যানের মায়াজমের বিশাল বর্ণনাকে সংক্ষেপে বলা যায় -
কু-মনন বা কুচিন্তায় অথবা চর্মরোগ চাপা পড়ায়/অপচিকিৎসায় সোরার সৃষ্টি, গনোরিয়ার চাপা পড়ায়/অপচিকিৎসায় সাইকোসিস সৃষ্টি, আর সিফিলিসের চাপা পড়ায়/অপচিকিৎসায় সিফিলিস মায়াজমের সৃষ্টি। যা প্রবাহিত হয় বংশ পরম্পরায় অধস্তনদের মধ্যে, যদি না উপযুক্ত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দ্বারা এদেরকে নির্মূল করা হয়। হ্যানিম্যানের মায়াজম তত্ত্ব বিশাল এক জ্ঞান, সংক্ষেপে বললাম কেবল সময় বাঁচানোর জন্য, তার জন্য সমালোচিত হতে পারি, কথা দিলাম পরবর্তী কোন সময়ে হ্যানিম্যানের মায়াজম তত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই মঞ্চেই করব, ইনশাল্লাহ।
এবার প্রথমেই বলছি ডাঃ রাজেন শংকরণের মায়াজম নিয়ে শ্রেণীবিভাগের কথা।
মায়াজমের শ্রেণীবিভাগ করতে গিয়ে হ্যানিম্যান যেভাবে মায়াজম ও ওষুধের শ্রেণীবিভাগ করেছেন রাজেন শংকরণ প্রথমে সেটিই গ্রহণ করলেন, তবে ব্যাখ্যা করলেন তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান দ্বারা, যেমন:-
একিউট মায়াজম: তরুণ রোগের কারণ, ওষুধের উদাহরণ - একোনাইট, বেলেডোনা, স্ট্র্যামোনিয়াম, হায়োসিয়েমাস ইত্যাদি সহ বহু ওষুধ।
ক্রনিক মায়াজম : চির রোগের কারণ, ওষুধের উদাহরণ –
সোরা: সালফার, সোরিনাম, ক্যাল্কে-কার্ব, লাইকোপডিয়াম।
সাইকোসিস : থুজা, মেডোরিনাম, নেট্রাম সালফ।
সিফিলিস : মার্কুরিয়াস, সিফিলিনাম, অরাম মেট, নাইট্রিক এসিড।
রাজন শংকরণের মায়াজমেটিক মতবাদকে বুঝার জন্য আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সহায়তা নেব। কেননা কোন ঘটনা, গল্প, কবিতা, ছন্দ ইত্যাদি মানুষের স্মরণে বেশী দিন জাগরূক থাকে, স্মৃতিতে আটকে থাকে।
সময় ১৯৭১ সাল, বাঙালীর স্বাধীনতার জন্য মুক্তি সংগ্রাম চলছে।
এই যুদ্ধের প্রধান চরিত্র -(১) বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ, (২) পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, (৩) বিশ্বাসঘাতক রাজাকার বাহিনী ।এই যুদ্ধে উপরোক্ত তিনটি চরিত্রের কার কি ভূমিকা ছিল আপনারা সবাই তা জানেন।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে সংগ্রাম শুরু হয়ে ৯ মাসের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ৯৩,০০০ সৈন্য বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর কবল মুক্ত হয়। রাজাকার বাহিনী আত্মগোপন করে। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।
এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে রাজন শংকরণের মায়াজম ধারণার মূল সুরটি অনুধাবন করা যায়।
একিউট মায়াজম : পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে ও হত্যা-লীলায় এবং রাজাকারদের অত্যাচারে বাঙালীদের মধ্যে প্রচণ্ড আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে একটি প্রচণ্ড হুমকি সকল পক্ষেই ছিল। এই হুমকি একিউট মায়াজম এর প্রধান উপাদান।
সিফিলিস মায়াজম : হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া অর্থাৎ ধ্বংসমূলক কাজ সিফিলিস মায়াজম এর প্রধান পরিচয় । সুতরাং এই কথা বলা যায় সিফিলিস = পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই ঘটনায় ধ্বংস, সিফিলিস এবং পাকিস্তানি বাহিনী সমার্থক শব্দ।
সাইকোসিস মায়াজম : সংগ্রামী বাঙালীদেরই একটি বিশ্বাসঘাতক, পাকিস্তানিদের সহযোগী পা চাটা বাহিনী হচ্ছে রাজাকার বাহিনী। এরা রাতের আধারে কাল কাপড়ে মুখ ঢেকে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে হত্যা করে, বাঙালী মা-বোনদের পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তুলে দেয় বা ইজ্জত নষ্ট করে বা হত্যা করে, মুক্তিবাহিনীর ভয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে বা ব্যাংকারে আশ্রয় নেয়, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর এরা গোপন স্থানে লুকিয়ে যায়, নিজের পরিচয় গোপন রাখে, আজ পর্যন্ত একজনও দাবী করার সাহস পায়নি যে আমি ১৯৭১ সনে রাজাকার ছিলাম। বাংলাদেশ সৃষ্টির ৪২ বৎসর পরেও তাদের মনে ও কাজে এখনও পরাজিত পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য, অসংশোধন-যোগ্য দুর্বলতা ও বদ্ধমূল ধারনা রয়েই গিয়েছে। এই ঘটনায় অসংশোধন-যোগ্য দুর্বলতা ও বদ্ধমূল ধারনা, গোপন স্থানে পলায়ন, পরিচয় গোপন করা, বিশ্বাসঘাতকতা করা, সাইকোসিস এবং রাজাকার বাহিনী সমার্থক শব্দ।
সোরা মায়াজম : মুক্তিকামী বীর বাঙালীর স্বাধীনতার মহান সংগ্রাম, মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগোপ্তা হামলা, শত অত্যাচার সত্ত্বেও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে না আসা, আশাহীন না হওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশেষ চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়া (জয় বাংলা রোগ) সোরা এবং সংগ্রামী বীর বাঙালী সমার্থক শব্দ।
সোরা অযৌন মায়াজমজাত ব্যাধি = বাঙালীদের চর্মরোগের ইতিহাস (জয় বাংলা নামক চর্ম রোগ) এবং সংগ্রামী জনগণ, এরা চিরদিনই সংগ্রামী, সংগ্রাম সোরার প্রধান বৈশিষ্ট্য, মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার সংগ্রাম যৌনতা জ্ঞাপক নয়। বাঙালীর মূল মন্ত্র ছিল- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাঙালী এখনও সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
সিফিলিস ও সাইকোসিস যৌন মায়াজমজাত ব্যাধি = পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর মধ্যে যৌনতার তথা ধর্ষণের ইতিহাস আছে, এটি পশুদের স্বভাব।
সিফিলিস ও সাইকোসিস উভয়ে ক্ষতি করার দিক দিয়ে একই বৈশিষ্ট্যের। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী ক্ষতি করার দিক দিয়ে একই বৈশিষ্ট্যের।
সিফিলিস ও সাইকোসিস ভাই ভাই, পাকিস্তানি ও রাজাকার ভাই ভাই।
হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া ইত্যাদি পাকিস্তানি বাহিনী (=সিফিলিস) ও রাজাকার বাহিনীর (=সাইকোসিস) প্রায় সমান বৈশিষ্ট্যের।
পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশে তাদের শাসন ক্ষমতা চিরদিনের জন্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছে (সিফিলিসের কাজ ধংষমূলক)
রাজাকার বাহিনী এখনও বিনাশ হয়নি, বাঙালী সমাজেই এরা গোপনীয় ভাবে অবস্থান করছে এবং পাকিস্তানের প্রতি অসংশোধন-যোগ্য দুর্বলতা ও আনুগত্য এখনো প্রকাশ করে যাচ্ছে। (সাইকোসিসের প্রধান বৈশিষ্ট্য গোপন-প্রিয়তা, গোপন স্থানের রোগ, বদ্ধমূল ধারনা, অসংশোধন-যোগ্য দুর্বলতা )
সুতরাং রাজন শংকরণের মায়াজম ধারণাকে স্মরণে রাখার জন্য
বাঙালীর সংগ্রামী চরিত্র = সোরার বৈশিষ্ট্য
রাজাকারের অসংশোধন-যোগ্য দুর্বলতা, বদ্ধমূল ধারনা ও গোপনীয় চরিত্র = সাইকোসিসের বৈশিষ্ট্য
পাকিস্তানি হানাদারদের ধংষমূলক কর্ম = সিফিলিসের বৈশিষ্ট্য
ইত্যাদি চরিত্র মনে রাখলে রাজন শংকরণের মায়জমের শ্রেণীবিভাগ বা চরিত্র বুঝতে সুবিধা হবে।
রাজন শংকরণের মায়াজমের ধারনার বাকি পরিচয় পাবেন পরবর্তী বক্তব্যে, সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীর সাথে বাকীটুকু মিলিয়ে নেবেন।
চলবে...........
ডাঃ এ. কে. এম. রুহুল আমিন
প্রভাষক
বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
সভাপতি, হ্যানিম্যান ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ।
খুব সুন্দর এবং উচুমানের চিন্তা সম্পন্ন একটি পোস্ট
Exceptional example..thanks sir....
Thanks both of you for comment...